হর কী পৌড়ি ঘাট
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়
“পা চালিয়ে চলো বাবা। দেখে এসেছি খাবার প্রায় শেষের দিকে। দেরি হলে কিছুই মিলবে না। চলো। ঐ তো আর একটুখানি…”
বিবেক আর কেয়া। মাঝেমধ্যে সময় পেলেই চলে আসে হরিদ্বারে। সুভাষ ঘাটের গঙ্গা ঘেঁসা এই লজেই ওঠে।
অত্যন্ত সাধারণ বিলাসবিহীন সাদামাটা লজের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বহমান স্রোতস্বিনী অপরূপা গঙ্গা দেখার অনিন্দ্য অনুভূতিই বারবার টেনে আনে এই পবিত্র গঙ্গা নগরী হরিদ্বারে।
সত্যি কথা বলতে এই লজ পছন্দের সম্পূর্ণ হকদার কিন্তু কেয়া। বিবেকের বিবেচনায় বেড়াতে এসে এইরকম একটা ধর্মশালা মার্কা লজে ওঠার কোনো মানেই হয় না। হরিদ্বারে লাক্সারি ডিলাক্স হোটেলের কি অভাব আছে?
কিন্তু কেয়ার যুক্তি অন্যরকম। তার মতে, বেড়াতে এসে এমনই জায়গায় থাকা উচিৎ যেখানে থেকে মনে হবে, হ্যাঁ বেড়াতে এসেছি। চোখের সামনে সর্বক্ষণ থাকবে সেই অনির্বচনীয় দৃশ্যগুলো যেগুলো দেখবার জন্যেই এতদূর ছুটে আসা।
হোটেলের বিলাসিতা করবার জন্যে বাইরে বেড়াতে আসার প্রয়োজন কী, ঘরে থাকাই ভালো।
সেই থেকে হরিদ্বারে এলেই এই লজই একেবারে পাকাপোক্ত আস্তানা।
এর বারান্দা থেকেই দেখা যায় পৌরাণিক আখ্যান ঘেরা মনোহর হর কী পৌরী ঘাট। গঙ্গা মাতার মন্দির। ভক্তবৃন্দের প্রবল স্রোত ধারায় শিকল মালা আঁকড়ে ধরে স্নান।
লজ থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে, ডান দিকে কয়েকটা চা, সিঙারা, পুরি, পরোটা ইত্যাদির দোকান।
দয়ালু ভক্তগণ এদের কাছেই সামর্থ অনুযায়ী টাকা দিয়ে, নরনারায়ণ সেবা করান। ব্যাবস্থাপনার দায়িত্ব থাকে দোকানদারের ওপর। তারা এ ব্যাপারে যথেষ্টই পটু।
কেয়ার এই ব্যাপারটা বড্ড ভাললাগার। তাই এখানে এলেই, নরনারায়ণ সেবার আয়োজন ও করেই। অবিশ্যি বিবেকেরও আন্তরিক সায় আছে এই ব্যাপারে।
তখন বিকেল তিনটে হবে হয়তো। একটি বছর দশেকের ছেলে, একটি অতি বৃদ্ধ মানুষকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে চলেছে, লক্ষ্য সেই ভোজন অনুষ্ঠান।
বিবেক লজের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিল সেই ঘটনা। বৃদ্ধের হাতে একটি বাঁশের লাঠি। যার ওপর ভর করে তার উপায়হীন অনিচ্ছাকৃত নড়বড়ে হাঁটাচলা। পরনে কমলা রঙের খাটো ধুতি। গায়ে একটি ময়লা চাদর।
রোগা হাড়জিরজিরে লোকটিকে ছেলেটি এমন আগ্রহ ভাবে নিয়ে চলছিলো, তাতে সেই মানুষটির প্রতি তার ভালোবাসা প্রবল ভাবে প্রকাশ পাচ্ছিলো।
খাবার যদি ফুরিয়ে যায়? মানুষটি খাবে কী? খাবারের জায়গায় না গেলে তো খাবার পাওয়া যাবে না। অন্যের জন্য খাবার নিয়ে আসাও নিয়ম বিরুদ্ধ। তেমন নিয়ম থাকলে ভালো হতো। তাহলে এই বয়স্ক মানুষটাকে এইভাবে দৌড় করাতে হতো না। কিশোর ছেলেটি একছুট্টে গিয়ে ওনার জন্য খাবার নিয়ে আসতে পারতো।
বিবেক সেই দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, এই দুজনের মধ্যে সম্পর্ক কী !
বাপ-ছেলে, দাদু-নাতি না কি কেউই নয়। নিছকই মুখ চেনা নাম ছাড়া কোনও এক স্বার্থহীন ভালোবাসার নির্মল সম্পর্ক। যে সম্পর্ক রক্তের কিংবা আত্মার তথাকথিত কেতাবী সংজ্ঞার বাইরে নির্ভেজাল মানবিক সম্পর্ক?
ছেলে কুন্তলের বিয়ে যখন পাকা। বিয়ের নিয়মমাফিক মার্কেটিং করতে করতে কেয়া আচমকা বলেছিল- ছেলের বিয়ের আনন্দে এলোমেলো খরচ কোরো না। ভবিষ্যৎ তোমার আমার কারুরই জানা নেই।
বিবেক ক্ষণিকের জন্য থমকে গিয়েছিল। ভালো লাগেনি কথাগুলো। কেয়া কী স্বার্থপর হয়ে উঠছে? নইলে একমাত্র সন্তানের বিয়েতে ওর মনে আশঙ্কা কেন?
এ কি সেই চিরাচরিত মেয়েলি সংস্কার? কর্তৃত্ব হারাবার ভয়? না-কি সুপরিকল্পিত বাস্তব ভাবনার ফসল?
বিবেক এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছিল, কুন্তলের বিয়ের বছর খানেকের মধ্যেই, যখন কুন্তল তার স্ত্রীকে নিয়ে নতুন ফ্যাটে চলে গেল। নিঃশব্দে, অকারণে। তাদেরকে একা করে দিয়ে।
কেয়া সেবারে যখন এখানে এসেছিল তখনও এই লজেই উঠেছিল। চেপে রাখা কান্না বুকে নিয়ে।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে বিবেক দেখেছিল, কেয়া নিঝুম বারান্দায় একাকিনী উদাসী।
বিবেক পাশে এসে দাঁড়াতেই বহমান গঙ্গার দিকে আঙুল দেখিয়ে কেয়া ফিসফিস করে বলেছিল, “দ্যাখো কী অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। অন্ধকারে ও যেন আরও রূপবতী। শুনতে পাচ্ছো ওর ছুটে চলার কলধ্বনি? কী মধুর তাই না?
আচ্ছা, ওর সঙ্গে ছুটতে ছুটতে চলতে চলতে হারিয়ে যাওয়া যায় না? কী গো যায় না?
বিশাল লম্বা চওড়া ঘাটের ওপর অনেক মানুষ সার সার শুয়ে পরম নিশ্চিন্তে রাত্রি নিদ্রায় অচেতন। মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়া শিশুর মতো তাদের মুখ।
হঠাৎ কেয়া, কিশোরীর মতন আদুরে গলায় বলে উঠেছিল,
“আচ্ছা, তুমি কখনও চন্দ্রাস্ত দেখেছ? দেখোনি না? ও-ই দ্যাখো…”
বিবেক অবাক চোখে দেখেছিল সেই মায়াময় অনির্বচনীয় দৃশ্য। যা সে আগে কখনও দেখেনি। সে কি ভোলবার!
এরপর ওরা এখানে এসেছিল প্রায় এক বছর পর। সেটা দশেরার রাত। এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আতসবাজির চোখধাঁধানো আলোর দিকে তাকিয়ে ধীর অকম্পিত গলায় কেয়া বলেছিল,
“একটা কথা বলবো, রাখবে?”
বিবেক কোনও কথা বলেনি। শুধু পরম ভালোবাসায় ওর হাতের ওপর হাত রেখেছিল।
-“তোমার সুবিধে মতো, যখনই সময় সুযোগ পাবে, এখানে এসে দরিদ্র মানুষগুলোকে অন্নদান কোরো। আর… “
-“আর?”
বিবেকের হৃদয় নিংড়ানো ব্যগ্রতা কেয়ার চোখ ভিজিয়ে দিয়েছিল। কেয়া সেটুকু আবেগ লুকিয়ে বলেছিল,
“যদি সম্ভব হয়, আমার অস্থি দেহভস্ম এই পবিত্র গঙ্গা বক্ষে বিসর্জন দিও। শ্রাদ্ধ নয়, একটু শ্রদ্ধা । তাতেই শান্তি তাতেই মুক্তি।”
বিবেক চমকে উঠে বলেছিল,
“কেয়া, কেমন করে এই ভয়ানক কথাগুলো এমন অবলীলায় উচ্চারণ করলে! বুক তো শুধু তোমার ভাঙেনি কেয়া। আমিও যে বাবা।”
-“তবুও, তোমার আর আমার মধ্যে একটা বিশাল ব্যবধান। আমি যে মৃত্যুপথ যাত্রী।”
বিবেক আঁতকে উঠেছিল,
-“কেয়া…”
অদূরে একটা আতসবাজি বিকট শব্দে ফেটে একরাশ ধোঁয়া ছড়িয়ে দিয়ে গেল। বাতাসে বারুদের গন্ধ।
“তুমি লুকিয়ে গিয়েছ। আমাকে ভয়মুক্ত রাখতে। বিশ্বাস করো, মাত্র এই একবারই আমি তোমায় অবিশ্বাস করেছি। তোমার কথা মিথ্যে ভেবেছি। তাই ডক্টর আদিত্য সেনকে ফোন করে সবচেয়ে কঠিন সত্যিটা জেনেছি। লাঙ্গ ক্যান্সার। ফাইনাল স্টেজ। হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা দিন।
ভালোই হলো জানো। জানি খুবই স্বার্থপরের মতো শোনালো কথাটা। সত্যিই তো শুধু নিজের কথাই ভাবছি।
তোমাকে কার কাছে রেখে যাচ্ছি; কে দেখবে তোমাকে; কী নিয়ে, কেমন করে, কার ভরসায় বাঁচবে তুমি? জানি না… জানি না… আমি কিচ্ছু জানি না, শুধু জানি, আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম আমৃত্যু শুধু তোমার সঙ্গে, শুধু তোমার সঙ্গে।”
বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়েছিল কেয়া।
গঙ্গার ওপারে দশাননের কুশপুত্তলি দাউদাউ করে পুড়ছে তখন। অজস্র রঙীন আতসবাজি ছেয়ে ফেলেছিল দশেরার মধ্যরাতের আকাশ।
একসময় শান্ত হলো সবকিছু। এখন গঙ্গাস্নান বন্ধ থাকবে কিছুদিন। সেই দীপাবলি পর্যন্ত। এটাই রেওয়াজ।
তারপর আবারও স্বাভাবিক হবে সবকিছু। যেমন চলছিলো প্রকৃতির নিয়মে। গঙ্গা বহে যাবে তার নিজস্ব ছন্দে। চন্দ্রোদয় থেকে চন্দ্রাস্ত আকাশগঙ্গায় জাগাবে মায়াজাল। গঙ্গা আরতির প্রজ্বলিত দীপশিখা
ঘন্টা ধ্বনির সাথে নৃত্য করবে নিত্যকার মতো। প্রতি সন্ধ্যায় সবুজ পাতার ডোঙায় ভেসে যাবে শতশত মনোকামনার দীপ।
“কালের” হাত ধরে “আজ” চলবে পথ আগামীর লক্ষ্যে অনন্তকাল ধরে, যুগে যুগে।
কপাটহীন হরির দুয়ার সদাই উন্মুক্ত। এখান থেকেই যে শুরু সকল দর্শনের, বিশেষত আত্মদর্শনের।
এখন নিশুতি রাতের নিঃস্তব্ধতার মাঝে জেগে আছে ভীষ্ম মাতা আর বিবেক। পৃথিবী যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন মৃত্যুপুরী।
কেয়ার দেহভস্মের কলসটি পরম ভালোবাসায় করপুটতলে নিয়ে শেষবারের মতো তার গায়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে চুম্বন এঁকে দিলো বিবেক।
সাক্ষী থাকলো আকাশ বাতাস অগনিত তারা গ্রহ নক্ষত্রপুঞ্জ আর ভাঙা চাঁদ।
সেই স্বর্গীয় প্রেমের স্পর্শ কেয়ার হৃদয়ে সুখ পৌঁছে দিতে পারলো কিনা বোঝা গেল না। তবে, ভস্মবাহিত কলসখানি ভীষ্ম মাতার পবিত্র কোলে দোল খেতে খেতে কোন সে অচিনপুরে হারিয়ে গেল, তা হয়তো মা গঙ্গাই জানেন।
মুহূর্তে বিবেকের মনে হলো, সে একা। সর্বস্ব খুইয়ে রিক্ত। চলৎশক্তিহীন একাকী অসহায় সঙ্গীহীন একটি অক্ষম মানুষ।
কে তাকে হাত ধরে নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় নিয়ে যাবে তার লক্ষ্যে?
নিশুতি রাতে, ব্যস্ততার কোলাহল থেমে যাওয়া নির্জন “হর কী পৌড়ি” ঘাটের মতো সেও নিঃসঙ্গ, একাকী।